মহররম ও আশুরাঃ ফজিলত, বৈশিষ্ট, রোজা ও শিক্ষা
মুহররম, একটি মহান বরকতময় মাস। হিজরি সনের প্রথম মাস । এটি ‘আশহুরে হুরুম’ তথা হারামকৃত মাস চতুষ্টয়ের অন্যতম। আশহুরে হুরুম সম্বদ্ধে আল্লাহ তাআলা বলেন: “নিশ্চয় মাসসমূহের গণনা আল্লাহর কাছে বার মাস আল্লাহর কিতাবে, (সেদিন থেকে) যেদিন তিনি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্য থেকে চারটি সম্মানিত, এটাই প্রতিষ্ঠিত দীন। সুতরাং তোমরা এ মাসসমূহে নিজদের উপর কোন জুলুম করো না।” [সূরা তাওবা:৩৬]
মহররম ও আশুরা
মহররম মাসের দশম দিবসকে ইসলামী পরিভাষায় আশুরা বলা হয় (ইবনে কুদামাহ রহঃ)। এ দিবসটি মহররম মাসের মর্যাদাকে আরো বৃদ্ধি করেছে। কারন-ইসলামী শরীয়তে মহররমের দশম দিবস তথা আশুরার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অত্যধিক। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় আগমন করে দেখতে পেলেন ইয়াহুদীরা আশুরার দিন রোযা পালন করছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা এ দিনে রোযা রাখছ কেন? তারা বলল, এটি একটি বিরাট সম্মানিত দিন।
আল্লাহ তায়ালা এ দিনে হযরত মূসা (আঃ) ও তার উম্মতকে নাজাত দিয়েছিলেন এবং ফেরাউন ও তার বাহীনীকে পানিতে ডুবিয়ে ধ্বংস করেছিলেন। তাই হযরত মূসা (আঃ) উহার কৃতজ্ঞতা স্বরুপ এ দিনে রোযা পালন করেছেন বিধায় আমরা এ দিনে রোযা রাখি।এতদশ্রবণে হযরত রাসূল কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হযরত মূসা (আঃ) এর নাজাতে কৃতজ্ঞতা আদায়ের ক্ষেত্রে আমরা তোমাদের (ইয়াহুদীদের) চেয়ে বেশী উপযুক্ত ও অধিক হকদার। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে ঐ আশুরার দিনে রোযা রাখেন এবং মুমিনদেরকেও রোযা রাখার হুকুম প্রদান করেন। (সহীহ বোখারী-২০০৪ ও সহীহ মুসলিম-২৭১৪ )
পবিত্র আশুরার তাৎপর্য
মুহাররম মাসের দশ তারিখ দিনটি হলো আশুরার দিন। দশ বুঝাতে আরবি ভাষায় ‘আশারা’ ব্যবহার করা হয়। আশারা থেকে আশুরা বা দশম দিবস। ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহ বিবেচনায় এ দিনটি আমাদের কাছে স্মরণীয় ও বরণীয়। এ দিনটি একদিকে যেমন নাজাত বা শুকরিয়ার দিবস। তেমনি অন্যদিকে কারবালার মরুপ্রান্তরে হযরত ইমাম হুসাইন রা. ও তাঁর সাথীদের শাহাদাতের ঘটনাও এ দিনে সংঘঠিত হওয়ায় তা আমাদের কাছে শোকাহত ঘটনার স্মারক। তাই এ দিনটি শোক দিবস হিসেবেও পরিচিত। কৃতজ্ঞতা ও শোক দিবসের মৌলিক তফাৎটি অনেকের কাছে সুস্পষ্ট না থাকায় তারা আশুরার মূল শিক্ষার বিকৃতি ঘটাচ্ছে।
অতীতে আশুরা দিবসে যেসব স্মরণীয় ঘটনা ঘটেছে সেগুলো থেকে কিছুতেই আমাদের চোখ বন্ধ করে রাখা সমীচীন হবে না। অনুরূপভাবে এ দিনে যেসব ফজিলত ও পালনীয় বিষয় রয়েছে সেগুলো থেকে কোনোভাবেই বিরত থাকা ঠিক হবে না।হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন, রমজানের পর আল্লাহর মাস মুহাররমের রোজা হলো সর্বশ্রেষ্ঠ। আর ফরজ নামাযের পর রাতের নামাযই হলো সর্বোত্তম। [সহীহ মুসলিম- ২/৩৬৮]
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুল সা. কে রমজান ও আশুরায় যেরূপ গুরুত্বের সাথে রোজা রাখতে দেখেছি, অন্য সময় তা দেখিনি। [সহীহ বুখারি- ১/২১৮] হযরত ইবনে আব্বাস রা. বর্ণিত অন্য এক হাদিসে এসেছে- নবী কারিম সা. মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার পর ইয়াহুদীদেরকে আশুরার দিনে রোজা রাখতে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা এ দিনে কিসের রোজা রাখ? জবাবে তারা বললো, এ দিন আল্লাহ তায়ালা হযরত মুসা আ. এবং তাঁর কওম বনি ইসরাইলকে ফেরাউনের হাত থেকে মুক্তি দেন, আর এ দিনেই ফেরাউন স্ব-দলবলে লোহিত সাগরে ডুবে মারা যায়। অতএব, আমরা এর শোকর আদায়ের লক্ষ্যে এবং উক্ত গৌরবময় দিনটির সম্মান জ্ঞাপনার্থে এ দিনটিতে রোজা রেখে থাকি। তাদের কথা শুনে হুজুর সা. বললেন, আল্লাহর নবী হযরত মুসা আ. এর অনুসরণের দাবিদার তোমাদের চেয়ে আমরা বহুগুনে বেশি।
অতঃপর (হুজুর সা. নিজে আশুরার রোজা রাখেন এবং) তাঁর উম্মতগণকেও এ দিনে রোজা রাখার নির্দেশ প্রদান করেন। [সহীহ বুখারি- ১/২৬৮] রাসুল সা.-এর এক সাহাবি থেকে আরেকটি বর্ণনায় এসেছে- রাসুল সা. ইরশাদ করেন, যদি কেউ মুহাররম মাসে রোজা রাখে, তাহলে প্রতিটি রোজার পরিবর্তে ত্রিশটি রোজার সওয়াব লাভ করবে। [তবরানি- ১১/৭২] অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, রাসুল সা. জনৈক সাহাবির প্রশ্নের উত্তরে বললেন, রমজানের পর যদি তুমি রোজা রাখতে চাও তবে মুহাররম মাসে রাখ। কারণ এটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যে দিনে আল্লাহ তায়ালা একটি জাতির তওবা কবুল করবেন। [জামে তিরমিজি- ১/১৫৭] উল্লেখ্য যে, এ হাদিসে রোজার পাশাপাশি তওবা ও ইস্তেগফারেরও ইঙ্গিত এসেছে।
আশুরার বৈশিষ্ট ও তার সওমের ফজীলত
দ্বীনে ইসলামে কিছু পর্ব বা দিবস আছে। যেগুলো আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নির্ধারণ করেছেন ইবাদত-বন্দেগী বা নেক আমল করার জন্য। এমনি একটা দিবসের নাম আশুরা। হিজরী সনের প্রথম মাস মুহাররমের দশ তারিখ। মুসলিম উম্মাহর দ্বারে কড়া নাড়ে প্রতি বছর।
এ মাস আমাদের স্বরণ করিয়ে দেয় আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হিজরত ও তার দাওয়াতী জিন্দেগী শুরু ও ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের কথা। এ মাসে রয়েছে এমন একটি দিন, দীর্ঘ সংগ্রাম শেষে যে দিনে নবী মুসা আ. এর বিজয় হয়েছিল। পতন হয়েছিল তখনকার সবচেয়ে শক্তিশালী জালেম সম্রাট ফেরআউন ও তার সম্রাজ্যের। সে দিনটিই হল আশুরা; মুহাররম মাসের দশ তারিখ।
এ দিনটি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে খুবই প্রিয়। তাই তিনি এ দিনে সওম পালনের সওয়াব প্রদান করে থাকেন বহুগুণে।
যেমন হাদীসে এসেছে
عن أبي هريرة رضى الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم أفضل الصيام بعد رمضان شهر الله المحرم، وأفضل الصلاة بعد الفريضة صلاة الليل. رواه مسلم
“আবু হুরাইরাহ রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেনঃ রসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ রমজানের পর সর্বোত্তম সওম হল আল্লাহর প্রিয় মুহাররম মাসের সওম। এবং ফরজ সালাতের পর সর্বোত্তম সালাত হল রাতের সালাত” বর্ণনায় : মুসলিম
আশুরার বৈশিষ্টের মধ্যে রয়েছে এ দিনে আল্লাহ তায়ালা তার নবী মুছা আ. ও তার অনুসারী ঈমানদারদের ফেরআউনের জুলুম থেকে নাজাত দিয়েছিলেন এবং ফেরআউনকে তার বাহিনীসহ সমুদ্রে ডুবিয়ে মেরেছেন।
সাহাবী ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত যে, রসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন মদীনায় আগমন করলেন তিনি আশুরার দিনে ইহুদীদের সওম পালন করতে দেখলেন। যেমন হাদীসে এসেছে
عن ابن عباس رضى الله عنهما: أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قدم المدينة فوجد اليهود صياما يوم عاشوراء، فقال لهم رسول الله صلى الله عليه وسلم : ما هذا اليوم الذي تصومونه؟ قالوا هذا يوم عظيم أنجى الله فيه موسى وقومه، وغرق فرعون وقومه فصامه موسى شكرا فنحن نصومه. فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم : فنحن أحق وأولى بموسى منكم. فصامه رسول الله صلى الله عليه وسلم وأمر بصيامه. رواه البخاري و مسلم
“ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনায় এসে দেখলেন যে, ইহুদীরা আশুরার দিনে সওম পালন করছে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন “এটা কোন দিন যে তোমরা সওম পালন করছ? তারা বললঃ এটা এমন এক মহান দিবস যেদিন আল্লাহ মুছা আ. ও তার সম্প্রদায়কে নাজাত দিয়েছিলেন এবং ফেরআউনকে তার দলবলসহ ডুবিয়ে মেরেছিলেন। মুছা আ. শুকরিয়া হিসেবে এ দিনে সওম পালন করেছেন। এ কারণে আমরাও সওম পালন করে থাকি। এ কথা শুনে রসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ “তোমাদের চেয়ে আমরা মুছা আ. এর অধিকতর ঘনিষ্ট ও নিকটবর্তী।” অতঃপর রসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সওম পালন করলেন ও অন্যদেরকে সওম পালনের নির্দেশ দিলেন। (বর্ণনায়ঃ বুখারী ও মুসলিম)
রসূলে কারীম (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইহুদীদের কথা বিশ্বাস করে সওম পালন করেছেন এমন নয়। সম্ভবত আল্লাহ তায়ালা অহীর মাধ্যমে ইহুদীদের এ বক্তব্যের সত্যতা জানিয়েছিলেন অথবা তিনি বিশ্বস্ত সূত্রে এর সত্যতা উপলদ্ধি করেছিলেন।
এ দিনে সওম পালনের ফজীলত সম্পর্কে হাদীসে আরো এসেছে
عن أبي قتادة رضى الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم: سئل عن صيام يوم عاشوراء، فقال يكفر السنة الماضية. رواه مسلم والترمذي
আবু কাতাদাহ রা. থেকে বর্ণিত যে, রসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে আশুরার সওম সম্পর্কে প্রশ্ন করা হল, তিনি বললেনঃ ” বিগত এক বছরের গুনাহের কাফফারা হিসেবে গৃহীত হয়।” বর্ণনায় : মুসলিম, তিরমিজী
অন্য বর্ণনায় এসেছে
عن أبي قتادة رضى الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : . . . . . صيام يوم عاشوراء أحتسب على الله أن يكفر السنة التي قبله. رواه مسلم
” আবু কাতাদাহ রা. থেকে বর্ণিত যে রসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ . . . . . . . . আশুরার দিনের সওমকে আল্লাহ তায়ালা বিগত এক বছরের গুনাহের কাফফারা হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন।” বর্ণনায় : মুসলিম
হাদীসে আরো এসেছে
من صام عاشوراء غفر الله له سنة. رواه البزار وحسنه الألباني في صحيح الترغيب والترهيب
“যে আশুরার সওম পালন করবে আল্লাহ তার এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।” বর্ণনায়ঃ বাযযার
ইমাম বায়হাকী (রহঃ) বলেনঃ “এ হাদীসের ব্যাখ্যা হলঃ যে সওম পালনকারীর গুনাহ রয়েছে তার গুনাহের কাফফারা হবে আর যার গুনাহ নেই আশুরার সওম তার মর্যাদা বৃদ্ধি করবে।” (ফাযায়েলুল আওকাত: বায়হাকী)
মোট কথা আশুরার দিনের সওম হল এক বছরের সওমতুল্য।
রসূলে কারীম (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ সওমকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে পালন করতেন। যেমন হাদীসে এসেছে
قال ابن عباس رضى الله عنهما : ما رأيت النبي صلى الله عليه وسلم يتحرى صيام يوم فضله على غيره إلا هذا اليوم يوم عاشوراء وهذا الشهر يعني شهر رمضان. رواه البخاري و مسلم
ইবনে আব্বাস রা. বলেনঃ “আমি রসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে এ সওম ছাড়া অন্য কোন সওমকে এত গুরুত্ব দিতে দেখিনি। আর তা হল আশুরার সওম ও এই রমজান মাসের সওম।” বর্ণনায় : বুখারী ও মুসলিম
আমাদের সালফে সালেহীন এ সওমকে গুরুত্ব দিয়ে পালন করতেন। এমনকি সফরে থাকাকালীন সময়েও তারা এ সওমকে পরিত্যাগ করতেন না। যেমন ইমাম ইবনে রজব (রহঃ) বর্ণনা করেছেন যে, ইবনে আব্বাস রা., আবু ইসহাক আস-সাবেয়ী, ইমাম যুহরী (রহঃ) প্রমুখ বলতেনঃ “রমজানের সওম কোন কারণে ছুটে গেলে অন্য সময়ে আদায় করার সুযোগ থাকে কিন্তু আশুরার সওম ছুটে গেলে আর রাখা যায় না।” (লাতায়েফুল মাআ’রিফ : ইবনে রজব)
তাই তারা সফরে থাকা অবস্থায়ও আশুরার সওম আদায় করতেন। নেক কাজে অগ্রণী হওয়ার ব্যাপারে এই ছিল আমাদের পূর্বসূরী ওলামায়ে কেরামের আদর্শ।
আশুরার রোজা কোন ধরনের পাপের জন্য কাফ্ফারা?
ইমাম নববি (রা.) বলেন, ‘আশুরার রোজা সকল সগিরা গুনাহের কাফ্ফারা। অর্থাৎ এ রোজার কারণে মহান আল্লাহ কবিরা নয় বরং (পূর্ববর্তী একবছরের) যাবতীয় সগিরা গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। এর পর তিনি বলেন, আরাফার রোজা দুই বছরের (গুনাহের জন্য) কাফ্ফারা, আশুরার রোজা এক বছরের জন্য কাফ্ফারা, যার আমীন ফেরেশতাদের আমীনের সাথে মিলে যাবে তার পূর্ববর্তী গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে… হাদিসে বর্ণিত এসব গুনাহ মাফের অর্থ হচ্ছে, ব্যক্তির আমলনামায় যদি সগিরা গুনাহ থেকে থাকে তাহলে এসব আমল তার গুনাহের কাফ্ফারা হবে অর্থাৎ আল্লাহ তার সগিরা গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। আর যদি সগিরা-কবিরা কোনো গুনাহই না থাকে তাহলে এসব আমলের কারণে তাকে সাওয়াব দান করা হবে, তার দরজাত বুলন্দ করা হবে। আর আমলনামায় যদি শুধু কবিরা গুনাহ থাকে সগিরা নয় তাহলে আমরা আশা করতে পারি, এসব আমলের কারণে তার কবিরা গুনাহসমূহ হালকা করা হবে।‘ {আল-মাজমূ শারহুল মুহাযযাব, ষষ্ঠ খন্ড, সওমু য়াওমি আরাফা}
বিভিন্ন ইসলামিক বিষয় পড়তে ভিজিট করুন www.IslamBangla.Com । সাথেই থাকুন Prosno.XyZ ভিজিট করতে থাকুন ।
শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া রহ. বলেন, ‘পবিত্রতা অর্জন, সালাত, রমজান, আরাফা ও আশুরার রোজা ইত্যাদি কেবল সগিরা গুনাহসমূহের কাফ্ফারা অর্থাৎ এসব আমলের কারণে কেবল সগিরা গুনাহ ক্ষমা করা হয়।‘ {আল-ফাতাওয়াল কোবরা, ৫ম খন্ড}
রোজার সাওয়াব দেখে প্রতারিত হওয়া চলবে না
আরাফা কিংবা আশুরার রোজার উপর নির্ভর করে অনেক বিভ্রান্ত লোক ধোঁকায় পড়ে যায়। আত্ম প্রতারিত হয়। এমনকি অনেককে বলতে শোনা যায়, আশুরার রোজার কারণে পূর্ণ এক বছরের পাপ ক্ষমা হয়ে গিয়েছে। বাকি থাকল আরাফার রোজা, তো সেটি সাওয়াবের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করবে।
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রা.) বলেন, এ আত্ম প্রবঞ্চিত-বিভ্রান্ত লোকটি বুঝল না যে, রমজানের রোজা ও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আরাফা ও আশুরার রোজার চেয়ে বহু গুণে বড় ও অধিক সাওয়াব যোগ্য ইবাদত। আর এগুলো মধ্যবর্তী গুনাহসমূহের জন্য কাফ্ফারা তখনই হয় যদি কবিরা গুনাহসমূহ থেকে বেঁচে থাকা হয়। সুতরাং এক রমজান থেকে পরবর্তী রমজান এবং এক জুমুআ থেকে পরবর্তী জুমুআ, মধ্যবর্তী সময়ে কৃত পাপের জন্য কাফ্ফারা তখনই হবে যখন কবিরা গুনাহ ত্যাগ করা হবে। উভয়বিধ কার্য সম্পাদনের মাধ্যমেই কেবল সগিরা গুনাহ মাফ হবে।
আবার কিছু বিভ্রান্ত লোক আছে, যারা ধারণা করে, তাদের নেক আমল বদ আমল থেকে বেশি। কারণ তারা গুনাহের ভিত্তিতে নিজেদের হিসাব নেয় না। এবং পাপাচার গণনায় আনে না। যদি কখনো কোনো নেক আমল সম্পাদন করে তখন কেবল তাই সংরক্ষণ করে। এরা সেসব লোকদের ন্যায় যারা মুখে মুখে ইস্তেগফার করে অথবা দিনে একশত বার তাসবিহ পাঠ করে অত:পর মুসলমানদের গিবত ও সম্মান বিনষ্টের কাজে লেগে যায়। সারা দিন আল্লাহর অসন্তুষ্টি মূলক কাজে অতিবাহিত করে। এসব লোক তাসবিহ তাহলিলের ফজিলত সম্বন্ধে খুব ফিকির করে। কিন্তু তার মাধ্যমে সংঘটিত অন্যায় ও পাপকর্মের প্রতি মোটেই দৃষ্টিপাত করে না। এটিতো কেবলই ধোঁকা ও আত্ম প্রতারণা। [আল-মওসুআতুল ফিকহিয়্যাহ, খন্ড ১৩, গুরুর]
আশুরায় উদযাপিত কিছু বেদআত
আশুরার দিন লোকেরা সুরমা লাগানো, গোসল করা, মেহেদি লাগানো, মুসাফাহা করা, খিচুড়ি রান্না করা, আনন্দ উৎসবসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করে থাকে এ সম্বন্ধে শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া রহ. কে প্রশ্ন করা হল, এর কোনো ভিত্তি আছে কি না?
জবাবে তিনি বললেন, এসব অনুষ্ঠানাদি উদযাপন প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সহিহ কোনো হাদিস বর্ণিত হয়নি এবং সাহাবাদের থেকেও না। চার ইমামসহ নির্ভরযোগ্য কোনো আলেমও এসব কাজকে সমর্থন করেননি। কোনো মুহাদ্দিস এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ ও সাহাবাদের থেকে কোনো সহিহ কিংবা জয়িফ হাদিসও বর্ণনা করেননি। তাবিয়ীদের থেকেও কোনো আছর পাওয়া যায়নি।
পরবর্তী যুগে কেউ কেউ কিছু বানোয়াট ও জাল হাদিস বর্ণনা করেছে যেমন, ‘যে ব্যক্তি আশুরার দিন সুরমা লাগাবে সে ব্যক্তি সে বছর থেকে চক্ষুপ্রদাহ রোগে আক্রান্ত হবে না’। ‘ যে ব্যক্তি আশুরার দিন গোসল করবে সে সেই বছর থেকে আর রোগাক্রান্ত হবে না। এরূপ অনেক হাদিস। এরই ধারাবাহিকতায় তারা একটি মওজু হাদিস বর্ণনা করেছে। যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালল্লামের প্রতি মিথ্যারোপ ব্যতীত আর কিছুই নয়। হাদিসটি হচ্ছে, অর্থাৎ, যে ব্যক্তি আশুরার দিন নিজ পরিবারের উপর উদার হাতে খরচ করবে আল্লাহ তাআলা সারা বছরের জন্য তাকে সচ্ছলতা দান করবেন। এ ধরণের সবগুলো বর্ণনা মিথ্যা ও জাল।
অত:পর শায়খ উল্লেখ করেছেন, -যার সার সংক্ষেপ হচ্ছে- এ উম্মতের অগ্রজদের উপর যখন সর্ব প্রথম ফেতনা আপতিত হল ও হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু’র শাহাদাত সঙ্ঘটিত হল। এর কারণে বিভিন্ন দলের লোকেরা কি করল? তিনি বলেন,
তারা জালেম ও জাহেলদের দলে রাপান্তরিত হল। হয়ত মুনাফিক বেদ্বীন নয়ত বিভ্রান্ত বিপথগামী। তাঁর বন্ধুত্ব ও আহলে বাইতের বন্ধুত্ব প্রকাশ করতে লাগল। আশুরার দিনকে রোলবিল, কান্নাকাটি ও শোক দিবস হিসাবে গ্রহণ করল। তাতে তারা বুক ও চেহারা চাপড়ানো, আস্তিন ছেড়াসহ জাহেলি যুগের বিভিন্ন প্রথা প্রকাশ করতে লাগল। বিভিন্ন শোকগাথা যার অধিকাংশই বানোয়াট ও মিথ্যায় পরিপূর্ণ ও গীত আবৃত্তি করতে লাগল। এর ভেতর সত্যের কিছুই নেই আছে শুধু স্বজনপ্রীতি ও মনোকষ্টের নবায়ন। মুসলমানদের পরস্পরে যুদ্ধ ও দুশমনি সৃষ্টির পায়তারা। পূর্ববর্তী পূন্যাত্মা সাহাবিদের গালমন্দ করার উপাদান। মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের অনিষ্টি ও ক্ষতির পরিসংখ্যান কেউ লিখে শেষ করতে পারবে না। তাদের মোকাবেলা করেছে হয়ত আহলে বাইত ও হোসাইন রা. -এর ব্যাপারে বাড়াবাড়িতে লিপ্ত নাসেবি সম্প্রদায় অথবা একদল জাহেল সম্প্রদায়। যারা ফাসেদের মোকাবেলা করেছে ফাসেদ দিয়ে। মিথ্যার মোকাবেলা মিথ্যার মাধ্যমে, খারাপের জবাব দিয়েছে খারাপ দিয়ে এবং বেদআতের জবাব বেদআতের মাধ্যমে।
মহররম ও আশুরায় শিক্ষণীয় বিষয়ঃ
১। কঠিন বিপদের পর ফিরে পাওয়া সুখ ও শান্তিতে আল্লাহর শুকর গুজারী করা।
২। মুমিনের উপর আল্লাহ তায়ালার সাহায্য ও বিজয়দানে সর্বদা পুলকিত হওয়া।
৩। জালিমদের অত্যাচার যত প্রবলই হোকনা কেন, বিজয় মুমিনদেরই। তবে এ ক্ষেত্রে মুমিনদের অনেক পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে এবং ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।
৪।সকল প্রকার বিপদ আপদে ধৈর্য্যধারন করা ও আল্লাহর উপর পূর্ণ তাওয়াক্কুল করা।
৫। অল্প আমলের মাধ্যমে বেশী সাওয়াব হাসিলের উৎসাহ প্রদান।
৬। ফযিলতপূর্ণ দিনে রোযা রাখার গুরুত্ব প্রকাশ।
সূত্রঃ ইমাম ও কোরানের আলো