সদকাতুল ফিতরার বিধান, কারা দিবে, কাদের দিবে! (Fitra)
সদকা অর্থ দান, ফিতর মানে রোজা সমাপন; সদকাতুল ফিতর অর্থ হলো রোজা শেষে ঈদুল ফিতরের দিনে সকালবেলায় শোকরিয়া ও আনন্দস্বরূপ যে নির্ধারিত সদকা আদায় করা হয়। এর দ্বারা রোজার ত্রুটিবিচ্যুতি মার্জনা হয়। গরিব মানুষ ঈদের আনন্দে শামিল হতে পারে। এই সদকা ঈদের নামাজের আগেই আদায় করতে হয়; সময়–সুযোগ না পেলে পরে হলেও আদায় করতে হবে। অনেকেই ঈদের আগে তথা রমজানেই আদায় করে থাকেন; এতেও কোনো অসুবিধা নেই; বরং এর দ্বারা গ্রহণকারী তা ঈদ উদ্যাপনে কাজে লাগাতে পারে।
ঈদের নামাজে যাওয়ার আগেই ফিতরা আদায় করা সর্বোত্তম। তবে আগে থেকে ফিতরা আদায়ে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। আর যদি কেউ কোনো কারণে ঈদের নামাজের আগে আদায় করতে না পারে তবে ঈদের পরেও তা আদায় করা যাবে।
কারা ফিতরা দেবেন, কাদের দেবেন?
ঈদের দিন সকালবেলায় যিনি সাহেবে নিসাব থাকবেন, তাঁর নিজের ও পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব। ছোট-বড় সবারই ফিতরা দিতে হবে। যাঁরা সাহিবে নিসাব নন, তাঁদের জন্যও ফিতরা আদায় করা সুন্নত ও নফল ইবাদত। অসহায় গরিব, ফকির, মিসকিন যারা জাকাত পাওয়ার যোগ্য, তারাই ফিতরার হকদার। ফিতরা নির্ধারিত খাদ্যসামগ্রী বা তার মূল্যে টাকায়ও আদায় করা যায় এবং অন্য কোনো বস্তু কিনেও দেওয়া যায়।
সদকাতুল ফিতরের ইতিহাস
আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, নবীজি (সা.)-এর জমানায় আমরা সদকাতুল ফিতর দিতাম এক সা (প্রায় সাড়ে তিন কেজি) খাদ্যবস্তু, তিনি বলেন, তখন আমাদের খাদ্য ছিল: যব, কিশমিশ, পনির ও খেজুর। (বুখারি, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ২০৪)। তিনি আরও বলেন: আমরা সদকাতুল ফিতর আদায় করতাম এক সা খাদ্যবস্তু বা (১) এক সা যব বা (২) এক সা খেজুর বা (৩) এক সা পনির অথবা (৪) এক সা কিশমিশ। (বুখারি, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ২০৫)।
সাহাবায়ে কিরামদের (রা.) অধিকাংশই খেজুর দ্বারা ফিতরা আদায় করতেন। ইবনে কুদামা (রা.) আবু মিজলাজের বর্ণনা উল্লেখ করে বলেন, তিনি আবদুল্লাহ ইবনে উমরকে (রা.) বললেন, ‘আল্লাহ তাআলা যখন প্রাচুর্য দিয়েছেন আর গম যেহেতু খেজুর অপেক্ষা উত্তম, তবুও আপনি খেজুর দ্বারা ফিতরা আদায় করছেন কেন?’ এর উত্তরে তিনি বলেছেন, ‘সাহাবিরা যে পথে চলেছেন আমিও সে পথে চলা পছন্দ করি।’
কীভাবে নিসফ সা (পৌনে দুই কেজি) প্রচলন হলো
নবী করিম (সা.)-এর যুগে মদিনায় গমের প্রচলন ছিল না বললেই চলে। পরবর্তী সময়ে যখন হজরত ওমর (রা.) খলিফা ও হজরত মুআবিয়া (রা.) শামের গভর্নর তখন মদিনায় গমের প্রচলন হয়। এ সময় হজরত মুআবিয়া (রা.)-এর ব্যাখ্যা ও খলিফা হজরত উমর (রা.)-এর নির্দেশে গম দ্বারা ফিতরা আদায়ের নিয়ম প্রবর্তন করা হয়।
আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন আমাদের মাঝে ছিলেন তখন আমরা ছোট, বড়, মুক্ত ক্রীতদাস সবার পক্ষ থেকে সদকাতুল ফিতর আদায় করতাম এক সা পনির বা এক সা যব বা এক সা খেজুর অথবা এক সা কিশমিশ। আমরা এভাবেই আদায় করছিলাম। একবার মুআবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান (রা.) হজ বা ওমরাহ করার জন্য এলেন, তিনি জনগণের উদ্দেশে মিম্বারে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিলেন। তখন তিনি বললেন, আমি দেখছি শামের দুই মুদ (নিসফ সা বা পৌনে দুই কেজি) আটা সমান হয় (মূল্যমান হিসেবে) এক সা খেজুরের। অতঃপর মানুষ এই মত গ্রহণ করলেন।
চার মাজহাবের ইমামদের মতামত
ইমাম আজম আবু হানিফা (রা.)-এর মতে, সদকাতুল ফিতর যেকোনো খাদ্যবস্তু এক সা; তবে গম হলে নিসফ সা। ইমাম মালিক (রা.), ইমাম শাফিয়ি (রা.) ও ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রা.)-এর মতে, সদকাতুল ফিতর এক সা পরিমাণ যেকোনো খাদ্যবস্তু।
দ্রুত গতিতে ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য আজই ডাউনলোড করুন MaxThon ব্রাউজার। আরও হাদিস পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
ইমাম আজম আবু হানিফা (রা.)-এর মতে, বেশি মূল্যের দ্রব্য দ্বারা ফিতরা আদায় করা অতি উত্তম; অর্থাৎ যা দ্বারা আদায় করলে গরিবদের বেশি উপকার হয়, সেটাই উত্তম ফিতরা। ইমাম মালিক (রা.)-এর মতে, খেজুর দ্বারা ফিতরা আদায় করা উত্তম। ইমাম শাফিয়ি (রা.)–এর মতে, হাদিসে উল্লিখিত বস্তুসমূহের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বোচ্চ মূল্যের দ্রব্য দ্বারা সদকা আদায় করা উচিত। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রা.)-এর মতে, সাহাবায়ে কিরাম (রা.)-এর অনুসরণ হিসেবে খেজুর দ্বারা ফিতরা আদায় করা উত্তম।
কোনো কোনো ফকিহ মনে করেন, যেকোনো খাদ্যদ্রব্য দ্বারা ফিতরা আদায় করা যায় এবং যেখানে যা প্রধান খাদ্য তা দ্বারা আদায় করাই শ্রেয়। অনেক গবেষক ফকিহ মনে করেন, বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য চাল, তাই আমাদের সদকাতুল ফিতর এক সা চাল হতে পারে। মুজতাহিদ ইমামদের মতে, যেসব খাদ্যবস্তু ১. সহজে সংরক্ষণযোগ্য, ২. সহজে বিনিময়যোগ্য ও ৩. বাজারমূল্য স্থিতিশীল থাকে; সেসব খাদ্যদ্রব্য দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করা যায়।
উত্তম ও ইনসাফপূর্ণ ফিতরা
খেজুর বা চাল বিভিন্ন দামের রয়েছে, এর মধ্যে কোনটি দ্বারা ফিতরা আদায় করা হবে? আসলে উত্তম হলো সর্বোচ্চ মূল্যের খেজুর বা চাল আদায় করা। তবে ধনীদের সর্বোচ্চ এবং সাধারণ মানুষদের মাঝামাঝি মূল্যে আদায় করাই শ্রেয়। ইনসাফ হলো যাঁরা যে চালের ভাত খান বা যাঁরা যে খেজুর দ্বারা ইফতার করেন, তাঁরা সে সমমানের বা সমমূল্যে ফিতরা আদায় করবেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ‘তা-ই উত্তম, দাতার কাছে যা সর্বোৎকৃষ্ট এবং যার মূল্যমান সবচেয়ে বেশি।’ (বুখারি, খণ্ড: ৩, পৃষ্ঠা: ১৮৮)।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী, যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।
smusmangonee@gmail.com